সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পগুলো দেশের মানুষকে আবারও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা এবং মহান আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, এ ভূকম্পনগুলো পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরে টেকটনিক প্লেটগুলোর (Tectonic Plate) চলমান কার্যকলাপের ফল। কিন্তু একজন মুমিনের দৃষ্টিতে ভূমিকম্প শুধু ভৌগোলিক ঘটনা নয়, বরং তা মানুষের জন্য গভীর ইমানি পরীক্ষা ও সতর্কবার্তাস্বরূপ।
তাই এ নিবন্ধে আমি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে ভূমিকম্পের কারণ এবং ইসলাম ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য করণীয় সম্পর্কে সবিস্তারে আলোকপাত করছি-
পবিত্র কুরআনে ভূমিকম্প
কিয়ামতের ভয়াবহ আলামত : পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ ও পরাক্রমের কথা বহুবার ঘোষণা করেছেন। ভূমিকম্প সেই ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণেরই একটি দৃশ্যমান প্রকাশ, যা কিয়ামত বা মহাপ্রলয়ের পূর্বাভাস বহন করে।
এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে আল্লাহ্ বলেন, ‘হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। নিশ্চয়ই কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ংকর ব্যাপার।’ (সূরা আল হাজ্জ-২২ : আয়াত-১)।
পৃথিবীর কম্পন ও বৃত্তান্তের বর্ণনা : পৃথিবীর যে কোনো কম্পন বা দুর্যোগ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর নির্দেশে ও ক্ষমতায় সংঘটিত হয়। কোনো প্রাকৃতিক শক্তিই আল্লাহর ইচ্ছার ঊর্ধ্বে নয়। এ সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘যখন পৃথিবী তার কম্পনে প্রকম্পিত হবে এবং পৃথিবী তার ভেতরের ভার বের করে দেবে। আর মানুষ বলবে, এর কী হলো? সেদিন জমিন তার সব বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। কারণ আপনার রব তাকে নির্দেশ দেবেন।’ (সূরা আঝ যিলযাল-৯৯ : আয়াত-১ থেকে ৫)।
কর্মফলের প্রতিফলন : ইসলামি আকিদা অনুযায়ী ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ অধিকাংশ সময়ই মানুষের পাপ, অন্যায় ও নৈতিক অবক্ষয়ের ফলস্বরূপ সংঘটিত হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমাদের ওপর যত বিপদ আসে, তা তোমাদের নিজেদের কর্মফলের কারণে, আর আল্লাহ তোমাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করে দেন।’ (সূরা আশ শুরা-৪২ : আয়াত-৩০)।
হাদিস শরিফে ভূমিকম্প
হাদিস শরিফে হজরত রাসূল (সা.) অধিক হারে ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়াকে কিয়ামতের অন্যতম আলামত হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। সমাজে যখন অন্যায়-অপরাধের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে সতর্ক করার জন্য ভূমিকম্প সংঘটিত করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসূল (সা.) বলেন-
‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না, যে পর্যন্ত না ইলম (প্রজ্ঞা ও বিবেক-বুদ্ধি) উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং খুনখারাবি বাড়বে।’ (বুখারি : ১০৩৬)।
ইসলামের দৃষ্টিতে ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য করণীয়
অধিক পরিমাণে তওবা-ইস্তিগফার করা : সম্মানিত পাঠক! পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরিফের বর্ণনা থেকে আমরা স্পষ্টতই অনুধাবন করতে পারলাম যে, মূলত আমাদের কর্মের প্রতিফল হিসাবেই মহান আল্লাহ ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত করে থাকেন। তবে আল্লাহতায়ালা তাঁর সৃষ্টির প্রতি পরম করুণাময়, ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তাই আমরা যদি এ দুর্যোগকালীন মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করি, তাহলে দয়াময় আল্লাহ দয়া করে আমাদের অবশ্যই ক্ষমা করে দেবেন এবং সব ধরনের বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা করবেন।
এ প্রসঙ্গে হজরত রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহতায়ালা তাকে সর্বপ্রকার বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত করেন।’ (সুনান আবু দাউদ : ১৫১৮)।
মহান আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখা : ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের সময় একজন মুমিনের কর্তব্য হলো মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা (তাওয়াক্কুল) রাখা ও ধৈর্য ধারণ করা। কেননা, পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা আল বাকারাহ-২ : আয়াত-১৫৩)। আর আল্লাহ যার সঙ্গে থাকেন, দোজাহানে তার ভয়ের কোনো কারণ থাকে না।
হজরত রাসূল (সা.)-এর ওপর অধিক দরুদ পাঠ করা : আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) হলেন সমগ্র সৃষ্টিজগতের রহমত। তাই আমরা যদি দুর্যোগকালীন আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর ওপর অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করি, তাহলে অবশ্যই মহান আল্লাহ আমাদের ওপর তাঁর রহমত বর্ষণ করবেন এবং ভূমিকম্পসহ সব ধরনের বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবেন। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসূল (সা.) নিজেই বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পড়ে, আল্লাহ তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করেন।’ (সুনান আন নাসাঈ : ১২৯৮)। আর স্বয়ং আল্লাহ যেখানে রহমত বর্ষণ করেন, গজব সেখানে কখনোই থাকতে পারে না।
সালাত আদায় করা : সালাত হচ্ছে মহান আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সংযোগ স্থাপনের শ্রেষ্ঠ উপায়। তাই বর্তমান সংকটময় সময়ে আমরা যদি কায়মনোবাক্যে ৫ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের পাশাপাশি বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করতে পারি, তাহলে দয়াময় আল্লাহতায়ালা নিশ্চয়ই আমাদের প্রতি দয়াশীল হবেন। আর বিপদের সময় সালাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা নিজেই বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সূরা আল বাকারাহ-২ : আয়াত-১৫৩)।
দোয়া করা : ভূমিকম্পসহ অন্যান্য বিপদাপদ ও দুর্যোগের সময় পাঠ করার জন্য অনেক দোয়া রয়েছে। তন্মধ্যে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত দোয়ায়ে ইউনূস অন্যতম প্রসিদ্ধ দোয়া। যা নিম্নরূপ-‘লা ইলা-হা ইল্লা আনতা সুবহা-নাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’ অর্থাৎ : ‘(হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই; তুমি পবিত্র, মহান! আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী।’ (সূরা আল আম্বিয়া-২১ : আয়াত-৮৭)।
এ ছাড়া হাদিস শরিফে একটি প্রসিদ্ধ দোয়া বর্ণিত হয়েছে, যা আল্লাহর রাসূল (সা.) বিপদকালীন মুহূর্তে পাঠ করতেন। দোয়াটি হলো, ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহুল আজিমুল হালিম, লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু রাব্বুল আরশিল আজিম, লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু রাব্বুস সামা-ওয়া-তি ওয়া রাব্বুল আরদ্বি ওয়া রাব্বুল আরশিল কারীম।’
অর্থাৎ : ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই; যিনি মহাজ্ঞানী ও ধৈর্যশীল। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই; যিনি সুবৃহৎ আরশের প্রতিপালক। আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই; যিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও সম্মানিত আরশের প্রতিপালক।’ (মুসলিম : ২৭৩০)।
সাদাকাহ (দান) করা : দুর্যোগ থেকে রক্ষা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে অন্যতম কার্যকর আমল হলো দান-সাদাকাহ করা। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সাদাকাহ আল্লাহতায়ালার ক্রোধ প্রশমিত করে এবং অপমৃত্যু রোধ করে।’ (তিরমিজি : ৬৬১)।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য করণীয়
ইসলামি নির্দেশনা অনুযায়ী আল্লাহর ওপর ভরসা করার পাশাপাশি সম্ভাব্য ক্ষতি কমাতে বিজ্ঞানসম্মত প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক। তাই ভূমিকম্প সহনশীল বিল্ডিং কোড পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করে নতুন ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে অবিলম্বে রেট্রোফিটিং (Retrofitting) [কাঠামোগত মানোন্নয়ন]-এর মাধ্যমে শক্তিশালী করতে হবে। প্রকৌশলীদের মতে, রেট্রোফিটিং দুর্বল কাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে সক্ষম। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি ভূমিকম্পের সময় তাৎক্ষণিক করণীয়ের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, যা নিম্নরূপ-
ঘরের ভেতরে থাকলে
দ্রুত একটি মজবুত ডেস্ক, টেবিল বা বেঞ্চের নিচে আশ্রয় নিন। কম্পন না থামা পর্যন্ত আশ্রয়স্থলটিকে শক্তভাবে ধরে রাখুন।
ধারেকাছে কোনো আসবাবপত্র না থাকলে মাথা এবং মুখ হাত দিয়ে ঢেকে ঘরের ভেতরে পিলার বা বিমের নিকটবর্তী দেওয়ালের পাশে বসে পড়ুন এবং দেওয়ালটিকে শক্তভাবে ধরে রাখুন।
কাচ, জানালা, বাইরের দরজা, দেওয়াল বা উঁচু আসবাবপত্রের কাছ থেকে দূরে থাকুন।
এলিভেটর বা লিফট ব্যবহার করবেন না।
আপনি যদি বিছানায় থাকেন, সেখানেই মাথা বালিশ দিয়ে ঢেকে রাখুন। যদি পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, বিছানার পাশে মেঝেতে আশ্রয় নিন।
ভবন থেকে বের হওয়ার কিংবা ছাদে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। ভূমিকম্পে বেশির ভাগ মানুষ তাড়াহুড়া করে বাইরে বের হতে গিয়ে আরও বেশি আহত হন।
পরিবারের সবার জন্য একটি ‘৭২ ঘণ্টা কিট’ তৈরি করে রাখুন। সেই কিটে খাবার পানি, শুকনো খাবার, প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, টর্চলাইট, হুইসেল, ব্যাটারিযুক্ত রেডিও এবং গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র (জাতীয় পরিচয়পত্র, প্রেসক্রিপশন ইত্যাদি) সংরক্ষণ করে রাখুন।
বাইরে থাকলে-
বাইরেই থাকুন।
বিল্ডিং, স্ট্রিটলাইট, গাছ ও বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে যান।
গাড়িতে থাকলে-
খোলা জায়গায় গাড়ি থামান এবং গাড়ির ভেতরেই থাকুন।
বিল্ডিং, গাছ, ওভারপাস কিংবা বৈদ্যুতিক তারের নিচে বা খুব কাছে গাড়ি থামাবেন না।
ক্ষতিগ্রস্ত সেতু বা ওভারপাসের ওপর দিয়ে বা নিচ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না।
ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়লে-
আগুন জ্বালাবেন না।
রুমাল বা কাপড় দিয়ে নাকমুখ ঢেকে নড়াচড়া কম করুন, যাতে শ্বাসনালিতে ধুলো না ঢুকে।
উদ্ধারকারীরা শুনতে পাবে, এমনভাবে পাইপ বা দেওয়ালে ধাক্কা দিয়ে শব্দ করুন; বাঁশি থাকলে ব্যবহার করুন।
শেষ উপায় হলে তবেই চিৎকার করুন। কেননা, চিৎকার করার সময় ধ্বংসস্তূপের ধুলো শ্বাসনালিতে ঢুকে বিপজ্জনক পরিস্থিতি হতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে পবিত্র কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী আমল করার পাশাপাশি বিজ্ঞানসম্মত প্রস্তুতি গ্রহণ করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করতে হবে, ঠিক তেমনি যার যার সাধ্য অনুযায়ী দুর্যোগপীড়িত মানুষের পাশেও দাঁড়াতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভূমিকম্প এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিরাপদ রাখুন। আমিন।
.png)
